কিভাবে এক স্বপ্নবাজ উদ্যোক্তা ও একদল সাহসী বাঙালি প্রতিষ্ঠা করলো বাংলাদেশ গার্মেন্ট সেক্টর

Sagar

আমরা সবাই জানি গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি আমাদের অর্থনীতির জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটা কি জানি যে এর পিছনে লুকিয়ে আছে ১৩০ জন সাহসী মানুষের গল্প যারা স্বপ্ন দেখেছিল। আজকে তাদের গল্প টাই বলব।

১৩০ থেকে ৪০ লক্ষ

১৯৭৪ সালে, রিচার্ড নিক্সন, দেশীয় বস্ত্র প্রস্তুতকারকদের চাপের প্রতিক্রিয়ায়, মাল্টি-ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্ট (এমএফএ) প্রণয়ন করেন, যা প্রতি বছর কতগুলি পোশাক দেশগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে রপ্তানি করতে পারবে তার উপর কঠোর কোটা নির্ধারণ করে।

দক্ষিণ কোরিয়া যখন এমএফএর অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার রপ্তানির সীমা শেষ করে দেয়, তখন তারা পশ্চিমে পোশাক উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি নতুন অংশীদার খুঁজতে শুরু করে। বাংলাদেশ, তখন একটি নতুন দেশ, দারিদ্র্যের চাপে এবং কম অবকাঠামো সহ, তার উন্নয়ন শুরু করার উপায় খুঁজছিল।

দক্ষিণ কোরিয়ার Daewoo Corporation একটি কোলাবরেশন এর মাধ্যমে প্রযুক্তি এবং জ্ঞান স্থানান্তর করার জন্য একটি স্বল্পান্নত দেশ এর খোঁজ করছিল ।নুরুল কাদের খান এটিকে একটি সুযোগ হিসাবে দেখেন।

তিনি Daewoo Corporation সাথে একটি চুক্তিতে আসেন যেখানে তিনি একদল কর্মীকে দক্ষিণ কোরিয়ায় ছয় মাসের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে পাঠাবেন। তখন কেইবা জানতো বাংলাদেশের প্রথম ১০০ শতাংশ রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস কারখানা শুরু করার স্বপ্ন বোনা শুরু হয়ে গিয়েছিল!

দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশ এর সাথে প্রশিক্ষণ এবং জ্ঞান বিনিময় করতে চাইছিল মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি চালিয়ে যাওয়ার জন্য ।এর ফলশ্রুতি তে ১৯৭৯ সালে, ১৩০ জন বাংলাদেশি দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠানো হয় পোশাক উৎপাদনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দিক শেখার জন্য। এটি এমন একটি পদক্ষেপ ছিল যা বাংলাদেশী গার্মেন্টস শিল্পের জন্ম হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই দলটা কেবলমাত্র গার্মেন্টস উৎপাদনের কলাকৌশল শেখেন নি , বরং ব্যবসা পরিচালনা, বিপণন, এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও বিস্তারিত ধারণা নেন। কারণ তাদের ভেতর ছিল একটি স্বপ্ন। প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়েছিল । তারা জানতেন দেশের গার্মেন্টস শিল্প কে এগিয়ে নিতে এই শিল্পের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গভীর জ্ঞান আরোহণ এর কোনো বিকল্প নেই।

প্রশিক্ষণের শেষে দেশে ফিরে আসার পর,নুরুল কাদের এই ১৩০ জন কর্মীর দক্ষতা ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে একটি যৌথ উদ্যোগে নামেন। ১৯৭৯ সালে সল্প বিনিয়োগ এবং কিছু ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে তিনি একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেন “দেশ গার্মেন্টস” নামে। প্রথমে ছোট পরিসরে শুরু হলেও, তাদের কর্মদক্ষতা, মানসম্পন্ন পণ্য এবং সময়নিষ্ঠ সরবরাহের কারণে তারা দ্রুত বাজারে পরিচিতি লাভ করে।

যে শিল্পটি ১৩০ জন দিয়ে শুরু হয়েছিল, তা আজ ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষের জীবিকা — যার মধ্যে ৩.৭ লক্ষ নারী । এই জ্যামিতিক বৃদ্ধির মূলে ছিল বাংলাদেশের প্রচুর এবং স্বল্পমূল্যের শ্রম সরবরাহ, এবং আমরা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক (আরএমজি) উৎপাদক, চীনের পরেই।

এছাড়াও, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের আরএমজি শিল্প অন্যান্য শিল্পে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে, বৃহত্তর অর্থনীতিতে আরও বেশি মূল্য যোগ করেছে। মুঠোফোনের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে — গ্রামীণ এলাকা থেকে আসা গার্মেন্টস কর্মীরা তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতে — এবং নতুন কারখানার প্রয়োজনীয়তা নির্মাণে একটি বুম সৃষ্টি করেছে। পোশাকগুলি বন্দর থেকে এবং বন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাজার হাজার চালক নিয়োগ করা হয়েছে, এবং শহর এবং তাদের গ্রামের বাড়ির মধ্যে গার্মেন্টস কর্মীদের শাটল করা প্রতিটি ছুটিকে দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আয় সৃষ্টিকারী করে তুলেছে।

এর পর থেকে, RMG খাতটি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৃহত্তম অবদানকারী হয়ে উঠেছে, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং দেশের রপ্তানি আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গঠন করেছে। এই রূপান্তরটি বাংলাদেশের সমাজ-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীর প্রভাব ফেলেছে, অনেকের জীবনমান উন্নত করেছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করেছে।

এই উদ্যোক্তাদের সফলতা আরো হাজার হাজার উদ্যোক্তাদের মনে বিশ্বাস তৈরি করেছিলযে সঠিক প্রশিক্ষণ এবং দৃঢ় সংকল্প থাকলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। তারা আরও বহু মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন।

বাংলাদেশের অন্যান্য যুবকদের জন্য এই গল্পটি একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। সঠিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে এবং দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এই সফল উদ্যোগ প্রমাণ করে যে, ইচ্ছা থাকলে এবং যথাযথ দিকনির্দেশনা পেলে, কোন কিছুই অসম্ভব নয়।